তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে সড়ক অবরোধ
ঢাকা এক দুর্ভোগের নগরী
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠণের পর থেকে প্রতিনিয়ত চলছে রাজপথে অন্দোলন ও মিছিল মিটিং ও সমাবেশ। ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী হামলার শিকার পুলিশ বাহিনী এখনো বেরুতে পারেনি হামলা আর সহকর্মী হত্যার ট্রোমা থেকে। এরই মাঝে কোন পূর্ব-ঘোষনা ছাড়া অপরিকল্পিত এসব আন্দেলন-বিক্ষোভ কর্মসূচি নাগরিক জীবনের অনাকাঙ্খিত দুর্ভোগ বাড়িয়েই চলেছে।
সাম্প্রতিক এই ধারাবাহিক আন্দোলনের (আনসার, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের দাবি আদায়, চাকরির বয়স ৩৫ করার দাবি, ছাত্র-ছাত্রীদের অটো পাশ, তিতুমীর কলেজসহ সাত কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় করা দাবি ও সবশেষ অটোরিকশা চলাচলের দাবি) তোড়ে রাজধানী ঢাকার সড়ক ও রেলপথের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েছেন বিমানবন্দরগামীরাও।
এই আন্দোলনের ধারবাহিকতায় ঢাকার সাথে একদিকে যেমন বন্ধ হয়ে যায় সড়ক পথের যোগাযোগ তেমনি রাজধানী সংলগ্ন সাভার, টঙ্গি-গাজীপুরের পোশাকখাত শ্রমিকরা দফায় দফায় বন্ধ করে দেন আন্তঃজেলার সড়কপথ। সবশেষ অটোরিকশা চালকদের আন্দোলনে প্রথমবারের মতো কিছু সময় বন্ধ থাকে পদ্মা সেতুর রেল যোগাযোগ।
এই আন্দোলনে দুর্ভোগের তালিকাতে সাধারণ মানুষ আর অফিসগামীদের পাশাপাশি রয়েছে পরীক্ষার্থী, চিকিৎসা প্রত্যাশী গর্ভবতী নারী, বিদেশগামী প্রবাসি থেকে সব শ্রেণী পেশার মানুষ।
এসময় আন্দোলনকারীদের শিক্ষার্থীদের হামলায় মহাখালী এলাকায় রক্তাক্ত হন শিশু নারীসহ একাধিক রেলযাত্রী, ঢাকা কলেজ এলাকায় সেনা সদস্যসহ অনেকেই।
সবশেষ আন্দোলনে বন্ধের দিন শুক্রবারও রাজপথে উচ্চ আদালতের নির্দেশের নিষিদ্ধ অটোরিকসা সংশ্লিষ্টরা। যদিও গোয়েন্দা তথ্য বলছে অটোরিকশা চালকদের ব্যানারে নামাদের বেশির ভাগই প্রায় আট হাজার কোটি টাকার বাৎসরিক চাঁদার সুবিধাভোগি স্বার্থান্বেষীরা।
গতকাল শুক্রবার তৃতীয় দিনের মত অটোরিকসা চালু থাকার পক্ষে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নামেন রাজধানীর জুরাইন এলাকায়। ঢাকা মাওয়া ও ঢাকা নারায়নগঞ্জ মহাসড়কসহ রেলপথও অবরোধ করেন। ২১ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় রাজধানীর সাথে। যানজট ছড়িয়ে পরে পুরো রাজধানী জুড়ে।
এসময় এক পথচারী অভিযোগের সুবে বলেন, কদিন পর আন্দোলন করবে ভিক্ষুকরা। ৫০টাকার নিচে ভিক্ষা না নেয়ার দাবিতে রাস্তা আটকাবে।
আন্দোলনের বিষয়ে ডিসি ওয়ারী আবু সালেহ বলেন, আদালতের নির্দেশের পর এধরনের আন্দোলন গ্রহণযোগ্য নয়। জনস্বার্থে পুলিশ এধরণের আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিহত করবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, স্বাধীনতা মানে কি যা ইচ্ছে তা-ই করা? অন্যের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা? এখন তো মনে হচ্ছে স্বাধীনতা মানেই সড়ক অবরোধ, রেলপথ অবরোধ। এখন যেটা দেখা যাচ্ছে, আমার ক্ষমতা আছে, ফলে আমি যা খুশি তা-ই করতে পারি।পরিস্থিতি এখন অনাচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। পরষ্পর পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ থাকাটা জরুরি।
তিনি আরোও বলেন, সারা বিশ্বের প্রতিটি দেশেই দাবি জানানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে। রাজনৈতিক দাবি হোক আর সামাজিক দাবি হোক- সবাই সেখানে গিয়ে দাবি জানান। এখানেও সেরকম নির্দিষ্ট জায়গা করে দেওয়া দরকার। সেই জায়গা কিন্তু আমাদের আছে। চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের আন্দোলন হতে পারে না। নব্বইয়ের দশকের শেষে দিকে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের যে রেওয়াজ চালু হয়েছে, এখনো সেটা চলছে। এই অবস্থার নিরসন দরবার।
হাইকোর্ট গত মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপের নির্দেশ দেন।
এদিকে ঢাকায় যখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন, তখন এটা বন্ধের দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন।
একই দিন রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় আফসানা করিম নামের এক ছাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। তারা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের দাবি জানান।
প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ী ইমরুল হাসান বলেন, সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে আগারগাঁওয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের অবরোধের মধ্যে পড়েছি। ফলে অনেকদূর ঘুরে ইস্টার্নপ্লাজার অফিসে আসতে হয়েছে। সরকারকে আসলে এসব ব্যাপারে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও শক্ত হতে হবে। এমনিতেই তো যানজটের কারণে ঢাকা শহরে চলাফেরা করা মুশকিল। ফুটপাতে হাঁটা যায় না। অগ্নিমূল্যের কারণে বাজারে গিয়ে সবজি কেনা যায় না। তাহলে এই শহরের মানুষ যাবে কোথায়?।
ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ, গত বুধবার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই দিন বেলা পৌনে ৩টার দিকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোতে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়। সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের একটি বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে সিটি কলেজের কয়েকজ শিক্ষার্থীর হাতাহাতি হয়।
এর জের ধরে সকালে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা গিয়ে সিটি কলেজে ভাঙচুর চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। তারা সায়েন্স ল্যাবের দিকে এগিয়ে যায়। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও বেরিয়ে এসে সায়েন্স ল্যাবের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হলে এলাকাটি একরকম রণক্ষেত্রের রূপ নেয়।
গত রবিবার লটারি নয়, মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে ভর্তির দাবিতে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। আসাদগেট থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও অবশ্য দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সড়ক ছেড়ে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর ওই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রুবাইদ হোসেন বলেন, আমার বাসা মিরপুর-১০ নম্বরে। মেয়ে পড়ে মোহাম্মদপুরের গ্রিনহেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। তার ক্লাস ছুটি হয় ১২টায়। রোববার মেয়েকে স্কুলে আনতে গিয়ে রেসিডেন্সিয়ালের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে পথে আটকে যায়। স্কুলে পৌঁছতে ১টা বেজে যায়। দেরি হওয়ার কারণে মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জ্বর এসে গেছে। অথচ বুধবার থেকে তার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এভাবে যদি কথায় কথায় সবাই সড়ক অবরোধ করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে চলবেন? দুইটায় আমার হাসপাতালের ডিউটিতে যোগ দেওয়ার কথা। সেখানে যেতে সাড়ে ৩টা বেজে গেছে। প্রতিনিয়তই আমরা এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ রাস্তায় নেমে দাবি জানাচ্ছেন। চাকরির বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে কয়েকদিন আগে হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তাদের দাবির মুখে চাকরিতে যোগ দেয়ার সর্বোচ্চ বয়স ৩২ বছর করা হয়। এরপর সচিবালয় ঘেরাও করে ৭ দফা দাবি জানায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি বাস্তবায়নে কমিটি করা হয়েছে।
এছাড়া সোমবার সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করাসহ তিনদফা দাবিতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে দিনভর আন্দোলন করেছেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। এতে মহাখালী থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকরা। অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা হন। আন্দোলন চলাকালে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা আন্তঃনগর ট্রেন ‘উপকূল এক্সপ্রেস' মহাখালীতে পৌঁছলে চলন্ত ট্রেনে আন্দোলনকারীরা হামলা-ভাঙচুর চালায়। এতে শিশুসহ অর্ধশতাধিক যাত্রী আহত হন। পরে তাদের দাবি পর্যালোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে মন্ত্রনালয়।
রাজধানীর সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নের উপায় জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্ল্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে দাবি-দাওয়ার পরিমান অনেক বেড়ে গেছে।
তবে এক্ষুনি সরকারের শক্ত অবস্থানের পক্ষে নন অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি বলেন, গত ১৫ বছর যারা কথা বলতে পারেনি, এখন তারা কথা বলছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এতদিন কথা বলেননি কেন? তারা তো কথা বলতে পারেনি, বলতে গেলেই তাদের গুম-খুন হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বলতে যে পারেনি, এই কারণেই তো জুলাইয়ের আন্দোলনে তারা অংশ নিয়েছে। ফলে এই সরকারের পক্ষে শক্ত হওয়া মুশকিল। এখন যারা দাবি করছে, তাদের অন্তত গুম-খুন হওয়ার ভয় নেই। ফলে তারা কথা বলার সাহস পাচ্ছেন। নির্বাচন যত এদিয়ে আসবে, এই দাবি হয়ত আরো বাড়বে। এই মুহুর্তে পরিস্থিতির উত্তরণে সরকারের শক্ত কোন পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
মন্তব্য করুন