কুষ্টিয়ায় আমন সংগ্রহ
‘বাজারেই দর বেশি, কষ্ট করে গুদামে নেব কেন’

এবার ১৩ বিঘা জমিতে ‘৫১ জাতের’ মোটা ধান আবাদ করেছেন কৃষক শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ফসল কাটা শেষ, মাড়াই চলছে। বাড়ির ওপর থেকেই প্রতিমণ ১ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোনোরকম কষ্ট-ভোগান্তি ছাড়াই সব ধান বেচে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই ধান সরকারকে দিতে হলে নানা ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। আমন সংগ্রহে ১ হাজার ৩২০ টাকা মণ নির্ধারণ করায় প্রতি মণে লোকসান ৩০ টাকা। আবার সেগুলো ট্রাক ভাড়া করে গুদামে নিতে হবে, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দায়িত্বরত আনসার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসদাচরণ সহ্য করতে হবে। এর সঙ্গে আছে ধান ভেজা, ওজনে কম, আবর্জনা বেশিসহ নানা অভিযোগে হয়রানি।
চলতি আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের অভিযান শুরু করেছে সরকার, চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গতবারের চেয়ে ২ টাকা বাড়িয়ে নতুন দরও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিকেজি ধান ৩৩, আর চাল ৪৭ টাকা করা হয়েছে। তবে স্থানীয় বাজারে এর চেয়ে বেশি মূল্য পাওয়ায় কুষ্টিয়া শহরতলির জুগিয়া-বারাদি ভাগার এলাকার কৃষক শরিফুলের মতো কেউ লোকসান দিয়ে ধান গুদামে নিতে ইচ্ছুক নন। আনারুল ইসলাম ও তাহের হোসেন বলেন, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মূল্য চড়া। এর পরও প্রতি মণে ৩০ টাকা এবং এর সঙ্গে বাড়তি ট্রাক ভাড়াসহ অর্ধশতাধিক টাকা লোকসান দিয়ে কেউ সরকারি গুদামে ধান নেওয়ার কথা নয়।
সচেতন নাগরিকরা মনে করেন, সরকারের চেয়ে বেশি দর দিয়ে ধান কিনছে মধ্যস্বত্বভোগী মিলাররা। তারা ধান কিনে মজুত করার পর বাজার চালাবে আঙুলের ইশারায়, ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে পকেট কাটবে ভোক্তার।
অন্যদিকে সরকার নির্ধারিত চালের দর নিয়েও খুশি নন মিল মালিকরা। বেশি দামে ধান কিনে সেগুলো থেকে চাল উৎপাদন করে সরকারকে দিতে তাদের খরচ বেশি পড়ছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। দাদা রাইস মিলের মালিক আরশাদ আলী বলেন, ‘সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ৩৩ টাকা কেজি। এ দরে ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আবার নির্ধারিত মূল্যে কিনলেও চাল তৈরি করে ৫০ টাকার নিচে বিক্রি করা কঠিন, এতে লোকসান হবে। চালের দাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ৪৭ টাকা। এর পরও দেশ ও জনগণের কথা ভেবে মিল মালিকরা চুক্তি করছেন।’
চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মিয়া ভাই অটো রাইস মিলের কর্ণধার জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের কাছে চালের দর পুনর্নির্ধারণের জন্য দাবি জানিয়েছি। আরও ২ টাকা বাড়াতে হবে, অন্যথায় মিল মালিকদের লোকসান হবে। তবে বেশি দামে ধান কেনার সঙ্গে মিলাররা নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হয়তো প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এটা করছেন।
এ ছাড়া ধান ও চাল সংগ্রহের পথে অন্যতম বাধা হলো গুদামে জায়গা সংকট। কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলা থেকে এ বছর ১৯ হাজার ১০০ টন সিদ্ধ চাল, ৬ হাজার ৭০০ টন ধান ও ১ হাজার ৬০০ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও এর ধারণ ক্ষমতা সরকারি গুদামের নেই।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তা আল ওয়াজিউর রহমান বলেন, যে পরিমাণ ধান ও চাল কেনা হবে, গুদামে তার অর্ধেক জায়গাও নেই। এ ছাড়া আগের কেনা চাল এখনও রয়ে গেছে। তাই নতুন করে গুদাম নির্মাণ করা জরুরি।
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, চালের সিন্ডিকেট দমন না করে সরকার নিজেই এবার দাম বাড়িয়েছে। এতে কৃষকের নামকাওয়াস্তে লাভ হলেও বহুগুণে চাপ বাড়বে ভোক্তার ওপর। মাঝে অন্যান্য বছরের মতো আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এভাবে কখনও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বরং, ইউনিয়ন পর্যায়ে গুদাম বাড়াতে হবে, কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে, সবশেষ উৎপাদিত শস্য ন্যায্যমূল্যে সরকারকেই সংগ্রহ করে সুষম বণ্টন করতে হবে।
মন্তব্য করুন