logo
  • বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১

একটি চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা

মফস্বলে নারী সাংবাদিকতার প্রসার ঘটেছে

আফরোজা সরকার

  ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৪৮


গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমকে সমাজের আয়না হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের প্রসার যেমন ঘটেছে তেমনি সাংবাদিকতার প্রসারও ঘটেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারী সাংবাদিকরাও এখন এই পেশায় এগিয়ে আসছেন। গণমাধ্যমে পুরুষ সংবাদিকরা যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন তেমনি এক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকরাও পিছিয়ে আছেন বলে মনে হয় না। সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হলেও বরং কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারী সাংবাদিকরা এগিয়ে আছেন। তবে সব গণমাধ্যমে যে নারীরা এগিয়ে আছেন সেটা বলা যাচ্ছে না।

সাম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানববাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া: নারী সাংবাদিকদের হয়রানির একটি জরিপে বেরিয়ে এসেছে এক ভায়াবহ তথ্য, তার আনশিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, শুধুমাত্র যে সকল গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিকদের জন্য অনুকূল পরিবেশ রয়েছে সেইসব গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিকরা পুরুষ সাংবাদিকের তুলনায় অনেক ভাল করেছেন। তবে এটা রাজধানী ঢাকার চিত্র হলেও মফস্বলের নারী সাংবাদিকেরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছেন। কারন মফস্বলে অফিসগুলোতে অনেকক্ষেত্রেই নারী সাংবাদিকদের কাজ করার মত অনুকূল পরিবেশ নেই।

নারী সাংবাদিকরা অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তা কিংবা সহকর্মীদের দ্বারা মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে হরহামেশাই। আর এসব বিষয়ে অভিযোগ করেও কোন লাভ হয় না। কারণ অনেকক্ষেত্রেই অফিসের শীর্ষ কর্তারাই এজন্য দায়ী এবং তারা নিজেরাই অপরাধী। শুধু তাই নয় এমনকি তাদের পারিশ্রমিক ও নিরাপত্তার বিষয়টিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যায়। আর এসব কারনে বেশিরভাগ নারী সাংবাদিক কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে সকল যোগ্যতা থাকা সত্বেও মফস্বলের অনেক নারী সাংবাদিকতার মত মহান এই পেশায় দক্ষতার ছাপ রাখতে পারছে না। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও দেখা যায় নারী সাংবাদিকরা প্রায়সময় নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজের দৃষ্কৃতিকারিদের অপকর্ম, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা ও রাজনৈতিক দুর্বত্তায়নের সংবাদ প্রকাশ করা হলে। নারী সাংবাদিককে প্রতিনিয়ত আজে বাজে ইঙ্গিত করে কথা বলে দৃষ্কৃতিকারিরা।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার, ও ইউটিউবে নারী সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। প্রথমে বন্ধুত্ব, এরপর ছলেবলে ফেসবুক মেসেঞ্জারে ক্ষুদে বার্তা বা কল দেওয়া শুরু করে, পরে ভিডিও কল দিতে চাওয়া, এসব পরিস্থিতিই প্রতিদিন একজন নারী সাংবাদিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এছাড়াও হামলা জোরপূর্বক যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের ভয়তো রয়েছে। এরপর ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আজেবাজে ছবি বা বার্তা পাঠানো হয় নারী সাংবাদিককে। এসবের বেশিরভাগ অ্যাকাউন্ট থেকে প্রেমের প্রস্তাব, উপহার পাঠানো, আবার নারী সাংবাদিকের কাছ থেকে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

আরো বলা যায়, সম্প্রতি এক নারী সাংবাদিককে ছলনা করে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করলে সেটি পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এক্ষেত্রে ছেলেটি পার পেয়ে গেলেও মেয়েটি ফেঁসে যায়। বেশি ভাগ তরুণী নারী সাংবাদিক এই পেশায় ঢুকেই এরকম ফাঁদে পড়েছেন। কিন্তু লজ্জায় তারা এসব বিষয় বলতে পারেন না। ভালো বেতন ও সুযোগ সুবিধার কথা বলে ফাঁদে ফেলে। ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্য করা হচ্ছে তরুণী নারী সাংবাদিকদের।

অপর এক নারী সাংবাদিক দুই সন্তানের মা। সহকর্মী সাংবাদিক নিয়মিত ফেসবুক মেসেঞ্জারে যৌন হয়রানিমূলক খুদে বার্তা পাঠান। প্রায়ই তাকে পর্নোগ্রাফিক নানা কিছু পাঠান এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনে জোরাজুরি করে কথা বলেতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ওই ভুক্তভোগী নারীকে ধর্ষণ করার প্রস্তাব দেয়, এমনকি টাকা-পয়সা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। তাকে। ওই ব্যক্তির পুরোনো আইডির সাথে নারী সাংবাদিকের অ্যাড ছিল, পরে আর আর একটি আইডি থেকে ওই সাংবাদিক সহকর্মী বন্ধু ফেসবুক ম্যাসেজারে যৌন হয়রানিমূলক খুদে বার্তা পাঠানো শুরু করেন। প্রায়ই তাকে পর্নোগ্রাফিক জাতীয় নানা কিছু পাঠান এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনে নানা প্রস্তাব দিতে থাকেন।। এমন পরিস্থিতিতে নারী সাংবাদিক দিশেহারা হয়ে পেশার প্রতি আস্থা হাড়িয়ে ফেলে। তবে এমন সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেও নারীরা মিড়িয়ায় টিকে রয়েছে এবং দিন দিন সাংবাদিকতার প্রসার ঘটছে। তবে এসব ঘটনায় শুধু নারী নয়, বন্ধু হিসেবে অন্য সহকর্মীরা এগিয়ে এলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে।

এক সময়ের পুরুষ আধিপত্যের একটি পেশা সাংবাদিকতা। ধরে নেওয়া হয় এই পেশা নারীর জন্য অনুকূল নয়। মনে করা হয় রাত-বিরাতে সংবাদের পেছনে ছোটা, যখন তখন অফিসে যাওয়া নারীদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিয়োগের সময় নিরুৎসাহিত করা হয়। পরিবার থেকে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়েরা আসেন এই পেশাটাকে ভালোবেসে। তারপরও টিকে থাকতে না পেয়ে ঝড়ে পড়ে। যাচ্ছে।

এর অন্যতম কারণ চাকরির নিরাপত্তা নেই, বেতনের নিশ্চয়তা নেই, কাজের মূল্যায়ন হয় না, দীর্ঘদিন কাজ করার পর পদোন্নতি হয় না, এমনকি পারিবারিক চাপ তো আছেই। যেহেতু অন্য আর দশটা পেশার মতো সাংবাদিকতা নয়। এখানে যথেষ্ট ছাড় দিতে হয় একজন নারীকে। পরিবারকে বঞ্চিত করছেন- সময় দিতে পারছেন না। ফলে অনেক ত্যাগ শিকার করে এই পেশায় এলেও যথাযথ মূল্যায়ন না হলে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

অনেক অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে এসে তার আগের জায়গাটা ফিরে পাচ্ছেন না। আগের দায়িত্ব পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি বাধ্য করে তাকে কাজ ছেড়ে দিতে। কখনোবা নিজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে কিছু করার চেষ্টা করেন। তার ভালোবাসার সাংবাদিকতা করা আর হয়ে ওঠে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুরুষকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। ধরে নেওয়া হয় পুরুষের পদোন্নতি প্রয়োজন, তাকে সংসার চালাতে হয়। পদোন্নতি হয় না আরেকটা কারণে, কর্তৃপক্ষ মনে। করে নারীকে বস হিসেবে মানবে না। কিন্তু বস নারী-পুরুষ যাই হোক যিনি কাজ করবেন তাকে তো অফিসের নিয়মকানুন মানতেই হবে। নারী বলে কেউ তো বঞ্চিত হতে পারেন না। কিন্তু নারী বলে তিনি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীর কাজের কোনো মূল্যায়ন হয় না।

তবে মেয়েদের কাজের প্রতি পরিবারের নৈতিক সমর্থন থাকতে হবে। তাহলে। তারা যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এছাড়া সকল বিষয়ে প্রযুক্তি মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা ফাঁদগুলো সম্পর্কেও তাদের অবহিত করতে হবে।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়