‘১২ বছর ধরে সংস্কার হয়নি’
রংপুরের বধ্যভূমিগুলো আজও অরক্ষিত রয়েছে

রংপুরের বধ্যভূমিগুলো আজও অরক্ষিত রয়েছে। গত ১২ বছর ধরে এই অঞ্চলের বধ্যভূমিগুলো কোন সংস্কার করা হয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা আলবদর-রাজাকারদের মাধ্যমে রংপুরের স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ অসংখ্য মানুষকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা করে। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থানের মধ্যে কিছু জায়গা চিহ্নিত করে সেগুলোতে বধ্যভূমি হিসাবে গড়ে তোলা হয়। তবে খুব একটা সুরক্ষিত নয় এসব স্থান। আবার কোথাও কোথাও এখনও চিহ্নিতই হয়নি অনেক জায়গা, যেখানে রয়ে গেছে একাত্তরের শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি।
অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকা বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় এর মধ্যে অনেকগুলো বধ্যভূমি বিলীন হওয়ার পথে। তার ওপর ব্যক্তিমালিকানায় যেসব স্থানে বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলো অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে আছে সংস্কার কাজ।
সর্বশেষ ২০১২ সালের দিকে রংপুর বিভাগের বধ্যভূমিগুলো সংস্কারের জন্য বরাদ্দ এসেছিল। কাজ শুরু করার পরপরই সেই বরাদ্দ শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে বরাদ্দ না আসায় অর্থাভাবে রংপুর বিভাগের দুই শতাধিক বধ্যভূমির সংস্কার ও সংরক্ষণের কাজ থমকে আছে। এসব বধ্যভূমি সংস্কারের ফাইল এক যুগেরও বেশি সময় ধরে লাল ফিতায় বন্দি রয়েছে।
তবে গণপূর্ত বিভাগ বলছে, খুব দ্রুত বরাদ্দ এলে কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া সরকারি জায়গায় বধ্যভূমি সংস্কারে কোনো জটিলতা না থাকলেও ব্যক্তি মালিকায় যেসব স্থানে বধ্যভূমি রয়েছে সেগুলো অধিগ্রহণের জটিলতায় সংস্কার কাজ আটকে আছে।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্থান তথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অমর করে রাখার জন্য এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সরকার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুর বিভাগের আট জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১০৮টি বধ্যভূমির ওপর জরিপ চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলো চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে সরকার মাত্র ৫০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে স্থান ও জমি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। সরকারি জমিতে থাকা বধ্যভূমি সংস্কারে কোনো সমস্যা না থাকলেও অনেক বধ্যভূমি রয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে। সেসব জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া বধ্যভূমির মধ্যে রংপুরের পাঁচটি বধ্যভূমি রয়েছে। কিন্তু এর তিনটি বধ্যভূমি ব্যক্তি মালিকানায় থাকায় সেসব জমি এখন পর্যন্ত অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সংস্কারের সিদ্ধান্ত শুধু কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে বাকি দুটির কিছুটা সংস্কার করা হয়।
রংপুরে ছোট-বড় অনেক বধ্যভূমি থাকলেও জেলা প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩টি চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- রংপুর টাউন হল, দখিগঞ্জ শ্মশান, সাহেবগঞ্জ, দমদমা, বালার খাইল, নব্দীগঞ্জ, লাহিড়ীরহাট, ঘাঘট নদী, নিসবেতগঞ্জ, জাফরগঞ্জ ব্রিজ, বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুর এবং মিঠাপুকুর উপজেলার জয়রাম আনোয়ারা বধ্যভূমি। এছাড়া জানা-অজানার মধ্যে রয়েছে মডার্ন সিনেমা হল, নারিরহাট, শংকরদহ, বৈরাগীগঞ্জ, বলদিপুকুর, দেবীপুর, শিবগঞ্জ এলাকা বধ্যভূমি এবং রংপুর সেনানিবাস গণকবর।
রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানা যায়, জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝড়ূয়ার বিল। সেখানে ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল এক সঙ্গে প্রায় এক হাজার ৫০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। আজও সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা ভোলেননি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। ২০১৬ সালে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু বধ্যভূমিটি এখনো রয়েছে অরক্ষিত।
রংপুর নগরীর হারাগাছ রোডের পাশে রংপুর জেলখানা থেকে ১৯ জন বন্দী ইপিআর সদস্যকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। সাহেবগঞ্জের মাঝামাঝি একটি স্থানে থাকা বধ্যভূমিতে শহীদদের গণকবর ছিল। ২০২০ সালে সংরক্ষণ কাজের সময়ে সেখান থেকে রক্তমাখা কাপড়সহ হাড়গোড় উদ্ধার হয়। বর্তমানে গণকবর না থাকলেও সেখানে নামফলকসহ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের হাজীরহাটে জাফরগঞ্জ সেতুতে ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল রংপুর শহরের ব্যবসায়ী অশ্বিনী ঘোষসহ ১৯ জনকে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। সেখানে আজও কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেন না জাফরগঞ্জ ব্রিজ বধ্যভূমির কথা।
অন্যদিকে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে তামপাট দমদমা সেতুর কাছে কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়, তার স্ত্রী মঞ্জু রানী রায়, চিত্তরঞ্জন রায়, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও সুনীল চক্রবর্তীসহ অনেক মুক্তিকামী মানুষকে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। বর্তমানে সেখানে বধ্যভূমির জায়গাটি নির্ধারণ করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সেটিও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।
রংপুর টাউন হল এলাকা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চার সেল। ওই স্থানে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করতো। এর পেছনের একটি কূপে ওই সব লাশ ফেলে দেওয়া হতো। ২০২০ সালে টাউন হল চত্বর বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে কূপ থেকে মানুষের বেশ কিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে। বর্তমানে সেখানে একটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানঘাটে ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাসের দুটি মেস থেকে ১১ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দলে দিনেশ চন্দ্র ভৌমিক মন্টু ডাক্তারের সঙ্গে ছিলেন রংপুরের ভাসানী ন্যাপ নেতা ইয়াকুব মাহফুজ আলী। অলৌকিকভাবে সেই দিন বেঁচে যান মন্টু ডাক্তার। এই বধ্যভূমিতে নামফলক ও শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। তবে শ্মশানের প্রবেশপথের পাশে থাকা স্মৃতিস্তম্ভটি দীর্ঘ দিন ধরে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে।
এছাড়া রংপুর সদরের রাজেন্দ্রপুরের বালারখাল, লাহিড়ীরহাট, কাউনিয়ার বলভবিসু, গঙ্গাচড়ার শংকরদহসহ বেশ কয়েকটি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলকও নির্মাণ করা হয়নি। আবার কোথাও কোথাও স্মৃতিফলক থাকলেও তা রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। কিছু অনেক বধ্যভূমি আজ দখলের মুখে।
গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, প্রথম দফায় ২০১২ সালের দিকে কিছু টাকার বরাদ্দ পাওয়া গেলেও পরে বরাদ্দ না আসায় শুরু হওয়ার পরপরই থমকে গেছে সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ। ফলে এখনো বধ্যভূমিগুলো অবহেলায় পড়ে রয়েছে। তা ছাড়া রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুরের বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না।
তথ্যানুসারে রংপুর বিভাগে সর্বমোট ৩৯৫টি গণহত্যা হয়েছে। এ গণহত্যার স্থানগুলোতে বা তার আশপাশে গণকবর ও বধ্যভূমি গড়ে উঠেছিল।অনেক বধ্যভূমি উন্মুক্ত ভূমি বা জলাশয় ছিল। ভূমিতে বা জলাশয়ে লাশ পচে-গলে মাটিতে মিশে গেলেও জমি যাতে হাতছাড়া না হয় সেজন্য বধ্যভূমিকে জমির মালিকরা খুব একটা স্বীকার করেন না। সঙ্গত কারণে বধ্যভূমিগুলোতে হালচাষ বা অবকাঠামোর আওতায় আসায় বধ্যভূমি হারিয়ে যেতে বসেছে।
রংপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু আক্ষেপ করে বলেন, অনেক বধ্যভূমি আজও সংরক্ষিত হয়নি। এসব বধ্যভূমি চিহ্নিত করে দ্রুত স্মৃতিফলক নির্মাণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে বধ্যভূমির সংরক্ষণ জরুরি।
রংপুর গণপূর্ত অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন বরাদ্দ না আসায় সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক বধ্যভূমির জমি ব্যক্তিমালিকায় রয়েছে। ওই সব জমি উদ্ধার করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। তারা বধ্যভূমির জমি উদ্ধার করতে না পারায় সেগুলো চিন্হিত করা যাচ্ছে না।
জাগতিক/ আফরোজা
মন্তব্য করুন